শনিবার ২১ ডিসেম্বর ২০২৪
সম্পূর্ণ খবর
Pallabi Ghosh | ০১ জুলাই ২০২৪ ১৫ : ২৬Pallabi Ghosh
ড. পিনাকী রঞ্জন রায়: সভ্যতার সূচনাকাল থেকে দুধ মানবজীবনে শারীরিক পুষ্টিসাধন ও বিকাশের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। শিশু জন্মের অব্যবহিত পরেই মাতৃদুগ্ধের মাধ্যমে পুষ্টি ও অনাক্রম্যতা লাভ করে। জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে দুধ এবং দুধ থেকে তৈরি খাদ্যদ্রব্য মানুষের শরীরের প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান সুষমভাবে জোগান দিয়ে থাকে। সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে গবাদি পশুর দুধ এবং দুধ থেকে তৈরি খাদ্যদ্রব্যের সামগ্রিকভাবে মানব স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও উন্নয়নে ভূমিকার ওপর ক্রমশ আলোকপাত হয়েছে এবং এর সঙ্গে সঙ্গে খাদ্য ও পুষ্টিদ্রব্য হিসাবে এর যে বিপুল সম্ভাবনা, তা উন্মোচনের জন্য পৃথিবীব্যাপী দুধ নিয়ে পড়াশোনা ও গবেষণার সম্প্রসারণ হয়েছে। পৃথিবী জুড়ে তৈরি হয়েছে তরল দুধ এবং দুগ্ধজাত দ্রব্যের প্রক্রিয়াকরণ শিল্প। ভারত তথা আমাদের রাজ্যও এর ব্যতিক্রম নয়। আজকের দিনে যেখানে মূল্য সংযুক্ত খাদ্যদ্রব্যের চাহিদা পৃথিবীব্যাপী প্রসারিত হয়েছে, সেখানে ডেয়ারি টেকনোলজি শিক্ষা ও গবেষণা জীবিকা অর্জনের একটি অন্যতম বিষয়রূপে শিক্ষাসমাজে গুরুত্ব লাভ করেছে। আমাদের দেশে প্রাণীজ প্রোটিনের ঘাটতি পূরণের জন্য দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্যদ্রব্যের গুরুত্ব অপরিসীম। সঙ্গত কারণেই বর্তমানে ডেয়ারি টেকনোলজি বা দুগ্ধ প্রযুক্তিবিদ্যা শিক্ষা ও গবেষণা ভারত তথা সমগ্র বিশ্বে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার বিষয় হিসাবে পরিগণিত হয়েছে।
ভারতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ডেয়ারি টেকনোলজির শিক্ষা ও গবেষণা প্রথম শুরু হয় ১৯২৩ সালে তদানীন্তন ব্যাঙ্গালোরে ইম্পিরিয়াল ইনস্টিটিউট অফ অ্যানিম্যাল হাজব্যান্ড্রি অ্যান্ড ডেয়ারিং প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। ইন্ডিয়ান ডেয়ারি ডিপ্লোমা (আইডিডি) ছিল ভারতে প্রথম ডেয়ারি টেকনোলজি শিক্ষার আনুষ্ঠানিক সোপান যা বেঙ্গালুরুর প্রতিষ্ঠানটিতে ১৯২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে শুরু হয়। স্বাধীনতা উত্তরকালে ইম্পিরিয়াল ইনস্টিটিউট হরিয়ানার কার্নালে স্থানান্তরিত হয় ভারতীয় দুগ্ধ অনুসন্ধান কেন্দ্র (ইন্ডিয়ান ডেয়ারি রিসার্চ ইনস্টিটিউট) নামে। ১৯৫৫ সালে ইন্ডিয়ান ডেয়ারি রিসার্চ ইনস্টিটিউট পুনঃনামাঙ্কিত হয় রাষ্ট্রীয় ডেয়ারি অনুসন্ধান কেন্দ্র (ন্যাশনাল ডেয়ারি রিসার্চ ইনস্টিটিউট) রূপে। বেঙ্গালুরুর প্রতিষ্ঠানটি এই অনুসন্ধান কেন্দ্রের দক্ষিণী আঞ্চলিক সংস্থা হিসাবে পরিচিত হয়। ১৯৬২ সালে তদানীন্তন বম্বে এবং ১৯৬৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের কল্যাণীতে রাষ্ট্রীয় ডেয়ারি অনুসন্ধান কেন্দ্রের যথাক্রমে পশ্চিমাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চল শাখা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫৭ সালে কার্নালে রাষ্ট্রীয় ডেয়ারি অনুসন্ধান কেন্দ্রে সর্বপ্রথম ডেয়ারি টেকনোলজিতে বিএসসি কোর্স চালু হয়। একই সময়ে পশ্চিমবঙ্গের হরিণঘাটা ও বম্বেতে ডেয়ারি টেকনোলজির ডিপ্লোমা শিক্ষার প্রসারণ ঘটে।
পশ্চিমবঙ্গে ডেয়ারি টেকনোলজির চার বছরের ডিগ্রি কোর্স প্রথম চালু হয় ১৯৭৭ সালে বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রাণী চিকিৎসা অনুষদের অধীনে। ১৯৯৫ সালে নবগঠিত পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্যবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্বতন্ত্র অনুষদরূপে ডেয়ারি টেকনোলজির আত্মপ্রকাশ ঘটে এবং ডেয়ারি টেকনোলজিতে বি টেক পাঠ্যক্রম চালু হয়। বর্তমানে বি টেকের পাশাপাশি এই অনুষদের অধীনে থাকা ডেয়ারি টেকনোলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং, কেমিস্ট্রি এবং মাইক্রো বায়োলজি বিভাগগুলিতে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পাঠ্যক্রমও চালু আছে।
কী কী কোর্স
পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্যবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন মোহনপুরস্থিত ডেয়ারি টেকনোলজি অনুষদের বর্তমান বি টেক (ডেয়ারি টেকনোলজি) কোর্সটি ভারত সরকারের কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ (ICAR) অনুমোদিত একটি চার বছরের পূর্ণাঙ্গ ডিগ্রি কোর্স। ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ প্রণীত একটি অভিন্ন পাঠ্যক্রমকে মান্যতা দিয়ে এই কোর্সটি পড়ানো হয়। বি টেক ডেয়ারি টেকনোলজি কোর্সে ভর্তি হওয়ার জন্য ছাত্র বা ছাত্রীকে ভারতীয় নাগরিক হিসাবে ভর্তির বছরের ৩১ ডিসেম্বর তারিখের নিরিখে ১৭ বছর বয়সী হতে হবে এবং পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতের স্বীকৃত কোনও বোর্ড থেকে ১০+২ বোর্ড পরীক্ষায় পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, অঙ্ক ও ইংরেজি–সহ ন্যূনতম ৫০ শতাংশ নম্বর পেয়ে পাশ করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্যবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের মোহনপুর ক্যাম্পাসের ডেয়ারি টেকনোলজি অনুষদের অধীন বি টেক (ডেয়ারি টেকনোলজি) কোর্সটিতে বর্তমানে ৪৯টি আসন রয়েছে, যার ৮০ শতাংশ ভর্তি হয় পশ্চিমবঙ্গ জয়েন্ট এন্ট্রান্স বোর্ড আয়োজিত প্রবেশিকা পরীক্ষার (WBJEE) মাধ্যমে। বাকি ২০ শতাংশ আসন ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ (ICAR) নিয়ন্ত্রিত এবং সেগুলি পূর্ণ হয় সর্বভারতীয় CUET পরীক্ষার মেধাতালিকার ভিত্তিতে।
নদিয়া জেলার মোহনপুরে অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গের ডেয়ারি টেকনোলজি অনুষদে বি টেক (ডেয়ারি টেকনোলজি) পাঠ্যক্রমের পাশাপাশি ডেয়ারি টেকনোলজি, ডেয়ারি ইঞ্জিনিয়ারিং, ডেয়ারি কেমিস্ট্রি এবং ডেয়ারি মাইক্রোবায়োলজিতে স্নাতকোত্তর পঠন পাঠনেরও সুবিধা রয়েছে।
কী পড়ানো হয়
বি টেক (ডেয়ারি টেকনোলজি) একটি চার বছরের পূর্ণাঙ্গ পাঠ্যক্রম যেটি আটটি সেমেস্টারে বিভক্ত। এতে ডেয়ারি টেকনোলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং, মাইক্রোবায়োলজি, কেমিস্ট্রি এবং বিজনেস ম্যানেজমেন্টের মতো বিষয়গুলি অন্তর্ভুক্ত এবং একজন ছাত্র বা ছাত্রীকে থিওরি বা তাত্ত্বিক এবং প্র্যাকটিক্যাল বা ব্যবহারিক শিক্ষালাভের পর ডিগ্রি অর্জন করতে হয়। তাত্ত্বিকা জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি ছাত্রছাত্রীদের দ্বিতীয় ও চতুর্থ সেমেস্টারে রেডি (READY) কর্মসূচির মাধ্যমে দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণের ওপর হাতেকলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। চার বছরের মধ্যে সপ্তম সেমেস্টারে ছাত্রছাত্রীরা ভারতের বিভিন্ন দুগ্ধজাত দ্রব্য উৎপাদন সংস্থায় ইনপ্ল্যান্ট ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে সম্যকভাবে প্রযুক্তিগত শিক্ষা ও জ্ঞান অর্জন করে।
উচ্চশিক্ষার সুযোগ
ডেয়ারি টেকনোলজিতে বি টেক করার পর দেশ ও বিদেশে উচ্চশিক্ষার প্রভূত সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে ভারতে প্রায় ৩০টি ডেয়ারি টেকনোলজি কলেজ রয়েছে এবং এদের মধ্যে অনেকগুলিতেই ডেয়ারি টেকনোলজির স্নাতকোত্তর পাঠ্যক্রম চালু আছে। এছাড়া ছাত্রছাত্রীরা সর্বভারতীয় পরীক্ষার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ডেয়ারি অনুসন্ধান কেন্দ্রের স্নাতকোত্তর পাঠ্যক্রমে ভর্তি হতে পারেন। গেট (GATE) পরীক্ষার মাধ্যমে বি টেক (ডেয়ারি টেকনোলজি) পাশ ছাত্রছাত্রীদের আইআইটি–গুলিতে ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং এবং রুরাল ডেভেলপমেন্টের স্নাতকোত্তর পাঠ্যক্রমে ভর্তির সুযোগ মেলে। এছাড়া ডেয়ারি টেকনোলজি স্নাতকদের সুযোগ রয়েছে কেন্দ্রীয় খাদ্য অনুসন্ধান সংস্থা (CFTRI)–র খাদ্য প্রযুক্তিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর পাঠ্যক্রমে ভর্তি হওয়ার। GRE এবং TOEFL পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ডেয়ারি বা খাদ্য প্রযুক্তির স্নাতকোত্তর স্তরে পঠনপাঠনের সুযোগও ডেয়ারি টেকনোলজির স্নাতকরা নিতে পারে।
স্নাতক কোর্সে উত্তীর্ণ হওয়ার পরে ছাত্রছাত্রীরা আগ্রহী হলে স্নাতকোত্তর বা গবেষণায় যেতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব প্রবেশিকা পরীক্ষার মাধ্যমে স্নাতকোত্তর পাঠক্রমগুলিতে ভর্তি হতে পারে।
কর্মসংস্থানের সুযোগ
বর্তমানে দেশের খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে প্রভূত কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। এর সঙ্গে সাযুজ্য রেখে ডেয়ারি টেকনোলজি স্নাতকদের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনাও অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। সাধারণভাবে বেসরকারি ক্ষেত্রে কর্সংস্থানের সুযোগ বেশি হলেও বিভিন্ন রাজ্যে সরকারি ও আধা সরকারি সংস্থায় ডেয়ারি টেকনোলজিস্ট নিয়োগ করা হয়ে থাকে। বর্তমানে রাজ্যের বিভিন্ন দুগ্ধ সমবায় কেন্দ্র, কেভেন্টার, আইটিসি, রেডকাউ ডেয়ারির মতো বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণ শিল্প সংস্থায় ডেয়ারি টেকনোলজিস্ট নিযুক্ত হয়। কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে ভিনরাজ্যের সমবায়, বেসরকারি দুগ্ধ ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প সংস্থায়, এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতেও। বর্তমানে ডেয়ারি টেকনোলজি অনুষদের স্নাতকরা ক্যাম্পাস ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে এই সমস্ত সংস্থায় কাজের সুযোগ পেয়ে থাকে। ভারতের বৃহত্তম দুগ্ধ সমবায় সংস্থা আমূল উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় ডেয়ারি টেকনোলজি স্নাতকদের নিযুক্ত করে থাকে।
স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি করা থাকলে ডেয়ারি টেকনোলজির ছাত্রছাত্রীরা নেট পরীক্ষা উত্তীর্ণ হওয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ডেয়ারি টেকনোলজি কলেজ ও গবেষণা সংস্থায় সহকারি অধ্যাপক, গবেষক বা বিজ্ঞানী হিসাবে নিযুক্ত হতে পারেন।
একজন ডেয়ারি টেকনোলজি স্নাতক কর্মজীবনের শুরুতে সংস্থাভেদে মাসে ৩০–৬০ হাজার টাকা আয় করতে পারেন। অভিজ্ঞতা অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে ডেয়ারি টেকনোলজি স্নাতকদের আয় দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। স্নাতকোত্তর পাঠ্যক্রমের পর সহকারি অধ্যাপক বা গবেষকদের প্রারম্ভিক মাসিক আয় ৬০–৭০ হাজার টাকা হয়ে থাকে।
ভবিষ্যতের রূপরেখা
বর্তমান সময়ে প্রক্রিয়াজাত দুগ্ধজাত দ্রব্য এবং মূল্যযুক্ত দুগ্ধজাত দ্রব্যের বাজার যেভাবে প্রসারিত হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করে বলা যায় যে ভবিষ্যতেও ডেয়ারি টেকনোলজির স্নাতকদের কর্মসংস্থানের অভাব হবে না। দুধ একটি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য এবং এর বাজার সর্বদাই প্রসারণশীল। মৌলিক পঠনপাঠনের পাশাপাশি হাতেকলমে সম্যক অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারলে ডেয়ারি টেকনোলজি শিক্ষা আগামিদিনে স্বচ্ছল জীবনযাপনের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। এতে প্রশিক্ষিত ডেয়ারি প্রযুক্তিবিদদের চাহিদা শিল্পক্ষেত্রে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাবে।
দরকারি কিছু ওয়েবসাইট
ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ
(https://icar.org.in)
পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্যবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়
(https://wbuafscl.ac.in)
রাষ্ট্রীয় ডেয়ারি অনুসন্ধান কেন্দ্র
(https://ndri.res.in)
কেন্দ্রীয় খাদ্য প্রযুক্তি অনুসন্ধান কেন্দ্রীয়
(https://cftri.res.in)